
Guillain-Barré Syndrome (GBS) বা স্নায়ু দুর্বলতার অসুখ এর কারণ এবং চিকিৎসা সমূহ | 2025
Guillain-Barré Syndrome (GBS) বা স্নায়ু দুর্বলতার অসুখ একটি বিরল কিন্তু গুরুতর স্নায়বিক রোগ, যেখানে শরীরের ইমিউন সিস্টেম ভুল করে নিজস্ব স্নায়ুকে আক্রমণ করে। এতে হাত-পা অসাড় হওয়া, দুর্বলতা, পেশিতে ব্যথা এবং এমনকি প্যারালাইসিস পর্যন্ত হতে পারে। সাধারণত ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণের পর এটি শুরু হয়। দ্রুত চিকিৎসা না পেলে শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা হতে পারে। চিকিৎসায় প্লাজমা এক্সচেঞ্জ, ইমিউনোগ্লোবুলিন থেরাপি ব্যবহৃত হয়। অনেক রোগী ধীরে ধীরে সুস্থ হয়, তবে কিছু ক্ষেত্রে স্থায়ী দুর্বলতা থাকতে পারে। GBS সম্পর্কে সচেতনতা এবং দ্রুত চিকিৎসা জীবন বাঁচাতে পারে।
Guillain-Barré Syndrome (GBS) বা স্নায়ু দুর্বলতার অসুখ হওয়ার কারণ
গিলিয়ান-ব্যারে সিনড্রোম (GBS) এক ধরনের অটোইমিউন রোগ, যেখানে শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বা ইমিউন সিস্টেম ভুল করে নিজের পেরিফেরাল নার্ভ সিস্টেম (Peripheral Nervous System)-কে আক্রমণ করে বসে। এতে করে নার্ভের আস্তরণ (myelin sheath) নষ্ট হয়ে যায়, ফলে স্নায়ুর স্বাভাবিক কার্যকারিতা ব্যাহত হয় এবং শারীরিক দুর্বলতা ও অসাড়তা দেখা যায়।
GBS সাধারণত কোনো ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ এর পরে দেখা যায়। সবচেয়ে সাধারণ কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- Campylobacter jejuni নামের একটি ব্যাকটেরিয়া—যা পেটের সমস্যা বা ডায়রিয়া ঘটায়। এটি GBS-এর অন্যতম সাধারণ কারণ।
- ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস, জিকা ভাইরাস, ডেঙ্গু, সার্স-কোভ-২ (COVID-19)-এর পরেও GBS দেখা গেছে।
- শরীরে অস্ত্রোপচার, ভ্যাকসিন গ্রহণ, কিংবা চোট কখনো কখনো শরীরে ইমিউন প্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে GBS ঘটাতে পারে।
GBS কিভাবে হয়, সেই পুরো মেকানিজম এখনো পুরোপুরি পরিষ্কার নয়, তবে গবেষকরা মনে করেন, সংক্রমণের পর কিছু ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার অণু শরীরের স্নায়ুর মতো দেখতে হয়। তখন শরীরের ইমিউন সিস্টেম সেগুলো আক্রমণ করতে গিয়ে নিজের স্নায়ুকেও আক্রমণ করে ফেলে যাকে বলা হয় “মলিকিউলার মিমিক্রি”।
সুতরাং, গিলিয়ান-ব্যারে সিনড্রোম এক ধরনের “ভুল আত্মরক্ষা প্রতিক্রিয়া”, যা শরীরের নিজের স্নায়ু ধ্বংস করে ফেলে এবং দুর্বলতা, ব্যথা, এমনকি পক্ষাঘাত পর্যন্ত সৃষ্টি করতে পারে।
Progeria বা অকাল বার্ধক্য রোগ এর কারণ এবং সমাধান | 2025
গিলিয়ান-ব্যারে সিনড্রোম (GBS) হলে জীবনযাপন কেমন হয়?
গিলিয়ান-ব্যারে সিনড্রোম (GBS) রোগে আক্রান্ত হওয়া ব্যক্তির জীবন হঠাৎ করেই এক কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যায়। প্রথমদিকে হাত-পায়ে দুর্বলতা, চলাফেরায় অসুবিধা, এমনকি পুরো শরীরে পক্ষাঘাতের মতো অবস্থাও হতে পারে। অনেক রোগীকে কয়েক সপ্তাহ বা মাস ধরে হাসপাতালে থাকতে হয় — কখনো কখনো ICU-তেও।
দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় পরিবর্তন
GBS আক্রান্ত ব্যক্তিকে অনেক সময় হুইলচেয়ারে চলাফেরা করতে হয়, কারণ পায়ের পেশি দুর্বল থাকে। হালকা কাজ করা বা দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টকর হয়। চলাফেরা, খাওয়া, গাড়ি চালানো বা স্নান করা — সবকিছুতেই সহায়তা লাগে।
ফিজিক্যাল থেরাপি ও মানসিক চাপ
ফিজিওথেরাপি এবং রিহ্যাব প্রোগ্রাম ছাড়া রোগীর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা কঠিন। প্রতিদিন পেশি ও নার্ভের শক্তি ফেরানোর জন্য নিয়মিত ব্যায়াম ও থেরাপি চালাতে হয়। এতে সময় ও ধৈর্য দরকার হয়।
এর পাশাপাশি রোগীরা মানসিক চাপ, হতাশা ও আতঙ্কে ভোগে। অনেকেই ভাবেন, তারা হয়তো আর আগের মতো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন না। তাই মানসিক সহায়তা, কাউন্সেলিং এবং পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সহযোগিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আশা ও পুনরুদ্ধার
ভাগ্যক্রমে বেশিরভাগ GBS রোগী ধীরে ধীরে সেরে ওঠেন। প্রায় ৮০%-৯০% মানুষ এক বছরের মধ্যে অনেকটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন। তবে কিছু মানুষের শরীরে দীর্ঘমেয়াদি দুর্বলতা বা সংবেদনজনিত সমস্যা থেকে যায়।
গিলিয়ান-ব্যারে সিনড্রোম (GBS) এর চিকিৎসা
গিলিয়ান-ব্যারে সিনড্রোম (GBS) একটি জরুরি স্নায়বিক অবস্থা, তাই যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা শুরু করা অত্যন্ত জরুরি। এই রোগের এখনো কোনো স্থায়ী প্রতিকার নেই, তবে কিছু আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে রোগীর অবস্থা উন্নত করা সম্ভব এবং জটিলতা কমানো যায়।
১. ইমিউনোগ্লোবুলিন থেরাপি (IVIG)
রোগ শুরুর প্রথম ২ সপ্তাহের মধ্যে এই থেরাপি সবচেয়ে কার্যকর। এতে রোগীর শিরায় (IV) ইমিউনোগ্লোবুলিন নামক প্রোটিন প্রবেশ করানো হয়, যা শরীরের ভুল প্রতিক্রিয়া বন্ধ করে স্নায়ু রক্ষা করে। এটি সাধারণত ৫ দিনের একটি কোর্স।
২. প্লাজমা এক্সচেঞ্জ (Plasmapheresis)
এই প্রক্রিয়ায় রক্তের প্লাজমা অংশ বের করে তাতে থাকা ক্ষতিকর অ্যান্টিবডি সরিয়ে ফেলা হয়। এতে ইমিউন সিস্টেমের ভুল প্রতিক্রিয়া কমে যায় এবং স্নায়ুর ক্ষয় হ্রাস পায়। এটি একটি দক্ষ চিকিৎসা পদ্ধতি, সাধারণত হাসপাতালে বিশেষভাবে করা হয়।
৩. ফিজিওথেরাপি ও রিহ্যাবিলিটেশন
রোগী দুর্বল হয়ে পড়ে বলে নিয়মিত ফিজিওথেরাপি ও রিহ্যাব প্রয়োজন। এতে পেশির শক্তি বাড়ে, হাঁটাচলার ক্ষমতা ফেরে এবং দৈনন্দিন কাজকর্মে সহায়তা মেলে।
৪. সহায়ক চিকিৎসা
- ব্যথা বা পেশির খিঁচুনির জন্য ওষুধ
- শ্বাসকষ্ট হলে অক্সিজেন বা ভেন্টিলেশন
- হৃদযন্ত্রের কার্যক্রম মনিটর করা
- সঠিক পুষ্টি ও যত্ন
GBS এর সঠিক ও দ্রুত চিকিৎসায় বেশিরভাগ রোগী ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। তবে পুরোপুরি সেরে উঠতে কয়েক মাস বা কখনো এক বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
মতামত
গিলিয়ান-ব্যারে সিনড্রোম (GBS) একটি ভয়ংকর কিন্তু প্রতিরোধযোগ্য ও চিকিৎসাযোগ্য রোগ। হঠাৎ করে চলাফেরার ক্ষমতা হারানো এবং নিজের শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার অভিজ্ঞতা অত্যন্ত মানসিক কষ্টের। কিন্তু সঠিক সময়ে চিকিৎসা, ফিজিওথেরাপি, মানসিক সহায়তা এবং পরিবারের ভালোবাসা একজন রোগীকে ধীরে ধীরে আগের জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারে। আমাদের সমাজে এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা দরকার, যাতে আক্রান্তরা অবহেলা বা ভয় না পায়। GBS শুধু একজন রোগীর নয়, পুরো পরিবারের মানসিক পরীক্ষাও বটে — তাই দরকার সহানুভূতি, ধৈর্য এবং ইতিবাচক মনোভাব।