
Wilson’s Disease বা শরীরে অতিরিক্ত কপার জমা রোগের কারণ এবং সমাধান | 2025
Wilson’s Disease একটি বিরল জেনেটিক রোগ, যেখানে শরীরের যকৃত (লিভার) অতিরিক্ত কপার (তামা) শরীর থেকে ঠিকভাবে বের করতে পারে না। ফলে তামা জমে যায় যকৃত, মস্তিষ্ক ও চোখে এবং ধীরে ধীরে তা ক্ষতি করে। এই রোগ সাধারণত শিশু বা কিশোর বয়সে ধরা পড়ে। উপসর্গের মধ্যে রয়েছে জন্ডিস, মানসিক পরিবর্তন, হাত কাঁপা ও কথা বলার সমস্যা। চোখে “কায়জার-ফ্লেইশার রিং” দেখা যায়। চিকিৎসায় কপার-নিষ্কাশনকারী ওষুধ ও খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবহৃত হয়। সঠিকভাবে ধরতে পারলে রোগটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য।
Wilson’s Disease (শরীরে অতিরিক্ত কপার জমা হওয়ার রোগ) কেন হয়
উইলসন রোগ একটি বংশগত জেনেটিক অসুখ, যার মূল কারণ হল ATP7B জিনে পরিবর্তন (mutation)। এই জিনটি শরীরের লিভারে তামা (Copper) প্রসেস ও নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করে। যখন এই জিনে ত্রুটি থাকে, তখন লিভার স্বাভাবিকভাবে অতিরিক্ত কপার শরীর থেকে বের করতে পারে না। ফলে কপার জমতে থাকে — প্রথমে যকৃতে, তারপর মস্তিষ্ক, চোখ, ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে।
এই রোগ অটোসোমাল রিসেসিভ পদ্ধতিতে উত্তরাধিকারসূত্রে হয়। মানে, যদি কোনো ব্যক্তির বাবা ও মা উভয়েই এই ত্রুটিযুক্ত জিন বহন করে, তাহলে সন্তানের মধ্যে এই রোগ দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই একই পরিবারের একাধিক সদস্যের মধ্যে উইলসন রোগ দেখা যেতে পারে।
তামা শরীরের জন্য একটি প্রয়োজনীয় খনিজ, যা অনেক খাদ্যে যেমন মাংস, বাদাম, দুধ, ও শাকসবজিতে থাকে। সাধারণত শরীর প্রয়োজন অনুযায়ী কপার গ্রহণ করে এবং অতিরিক্ত অংশ পিত্ত (bile) এর মাধ্যমে বের করে দেয়। কিন্তু উইলসন রোগে এই প্রক্রিয়া ভেঙে পড়ে, এবং অতিরিক্ত তামা জমে গিয়ে বিষক্রিয়া ঘটায়।
রোগটি সাধারণত ৫–৩৫ বছর বয়সের মধ্যে ধরা পড়ে, তবে কখনো কখনো শিশু বা বয়স্কদের মধ্যেও দেখা যেতে পারে। এটি ধীরে ধীরে শরীরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, বিশেষত লিভার সিরোসিস, মানসিক সমস্যা, স্নায়ুবিক দুর্বলতা এবং চোখের কোণায় বাদামি রঙের রিং (Kayser-Fleischer ring) এর মাধ্যমে লক্ষণ প্রকাশ পায়।
Guillain-Barré Syndrome (GBS) বা স্নায়ু দুর্বলতার অসুখ এর কারণ এবং চিকিৎসা সমূহ | 2025
Wilson’s Disease হলে জীবনযাপন কেমন হয়?
উইলসন রোগ ধরা পড়ার পর একজন রোগীর জীবন পুরোপুরি বদলে যায়। কারণ এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি, জেনেটিক এবং অঙ্গ-প্রতঙ্গ ধ্বংসকারী রোগ। তবে সঠিক চিকিৎসা ও নিয়ম মেনে চললে একজন রোগী বেশ স্বাভাবিক ও কার্যকর জীবনযাপন করতে পারেন।
নিয়মিত চিকিৎসা ও ওষুধ
Wilson’s Disease এর প্রধান চিকিৎসা হল এমন ওষুধ গ্রহণ করা যা শরীর থেকে অতিরিক্ত তামা (Copper) বের করে দেয়—যেমন Penicillamine, Trientine, বা Zinc। এই ওষুধগুলো প্রায়ই সারা জীবন চালিয়ে যেতে হয়। রোগীর প্রতিদিন ওষুধ খাওয়া, ডোজ ঠিক রাখা এবং নিয়মিত রক্ত ও ইউরিন পরীক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
খাদ্যাভ্যাসে কঠোর নিয়ন্ত্রণ
রোগীরা এমন খাবার পরিহার করতে বাধ্য হন যেগুলোতে বেশি কপার থাকে—যেমন:
- কলিজা, শুক্তি, কডলিভার অয়েল
- চকোলেট, বাদাম
- ঝিনুক, চিংড়ি
- কপার পাইপের পানি
এছাড়া অনেক রোগীকে খনিজজুক্ত পানি বা সাপ্লিমেন্ট থেকেও বিরত থাকতে হয়। ফলে জীবনযাত্রায় শৃঙ্খলা, সচেতনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ খুব জরুরি হয়ে পড়ে।
মানসিক ও সামাজিক প্রভাব
উইলসন রোগের কিছু রোগীর মধ্যে মানসিক অসুস্থতা (যেমন ডিপ্রেশন, মুড সুইং, স্মৃতিভ্রষ্টতা) দেখা দেয়। ফলে পরিবার ও বন্ধুদের সহানুভূতি ও মানসিক সমর্থন অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
Wilson’s Disease এর চিকিৎসা
উইলসন রোগ একটি জেনেটিক রোগ হলেও, সময়মতো চিকিৎসা শুরু করলে এটি সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এই রোগের মূল লক্ষ্য হল শরীর থেকে অতিরিক্ত তামা (Copper) অপসারণ করা এবং ভবিষ্যতে কপার জমা রোধ করা।
১. কপার অপসারণকারী ওষুধ (Chelation therapy)
এই ওষুধগুলো শরীরের কপারকে বাঁধতে সাহায্য করে এবং ইউরিনের মাধ্যমে তা বের করে দেয়।
প্রধান ওষুধগুলো হলো:
- Penicillamine: সবচেয়ে প্রচলিত কেলেশন থেরাপি। এটি কার্যকর হলেও অনেক সময় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে যেমন চামড়ায় র্যাশ, জ্বর, কিংবা রক্তে পরিবর্তন।
- Trientine: বিকল্প ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয় যারা Penicillamine সহ্য করতে পারেন না।
২. Zinc থেরাপি
Zinc শরীরের অন্ত্রে কপার শোষণ বন্ধ করে। এটি মূলত রোগ নিয়ন্ত্রণে চলে আসার পর রক্ষণাবেক্ষণ চিকিৎসা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। Zinc তুলনামূলক নিরাপদ এবং দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর।
৩. ডায়েট নিয়ন্ত্রণ
রোগীকে কম কপারযুক্ত খাবার খেতে বলা হয়, যেমন:
- বাদাম, চকোলেট, মাশরুম, ঝিনুক, কলিজা—এসব খাবার এড়িয়ে চলা জরুরি।
- পানি যদি কপার পাইপ থেকে আসে, তবে ফিল্টার ব্যবহার করা প্রয়োজন।
৪. লিভার প্রতিস্থাপন (Liver transplant)
যদি রোগী দেরিতে ধরা পড়ে বা গুরুতর লিভার ফেইলিওর দেখা দেয়, তখন লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করতে হতে পারে। এতে রোগী নতুন জীবন পেতে পারেন।
মতামত
উইলসন রোগ একটি জেনেটিক অসুখ হলেও, এটি এমন একটি রোগ যা সঠিক সময়ে ধরা পড়লে এবং নিয়ম মেনে চিকিৎসা নিলে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। দুঃখজনক হলেও সত্য, অনেক ক্ষেত্রেই রোগটি দেরিতে ধরা পড়ে — যার ফলে লিভার, স্নায়ু এবং মস্তিষ্ক স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই, শিশু বা তরুণদের মধ্যে আচরণগত পরিবর্তন, লিভারের সমস্যা বা অস্বাভাবিক কাঁপুনি দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
এই রোগ চিকিৎসা করা যায় — তবে রোগীকে ওষুধ নিয়মমাফিক খেতে হবে, খাদ্যাভ্যাসে কঠোর নিয়ম মানতে হবে, এবং নিয়মিত ফলো-আপ করাতে হবে। Wilson’s Disease সারা জীবনের একটি দায়িত্ব, তবে এটি কোনো মৃত্যুদণ্ড নয়। সমাজ ও পরিবারের সহানুভূতি, মানসিক সহায়তা এবং স্বাস্থ্যসেবার প্রাপ্যতা একজন রোগীর আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে পারে।
সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার, যাতে রোগটি প্রথম দিকেই শনাক্ত হয় এবং রোগীরা সামাজিক ও মানসিকভাবে পিছিয়ে না পড়ে। স্বাস্থ্যবান ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজন তথ্য, সচেতনতা ও সহানুভূতি।